আমার মা কে যদি আমার জন্মতারিখ জিজ্ঞেস করা হয়,চট করে বলে দিবে আগন মাসের ৩ তারিখ।এই আগন মাস মানে অগ্রহায়ণ মাস।আমাদের গ্রামে আঞ্চলিক উচ্চারণ এমনই। আমার মা কথা বলার সময় আঞ্চলিকতা ছাড়তে পারেনি বহুবছরেও।
আমার জন্ম যেহেতু গ্রামে, আর অগ্রহায়ণ মানে গ্রামের বাড়িতে কনকনে শীত।এমনই এক অগ্রহায়ণ এর তিন তারিখ আর নভেম্বরের ১৮ তারিখে আমার জন্ম।অবশ্য মা বলে এশা’র আযান যখন নাকি মাইকে দেওয়া হচ্ছিল চারপাশে, সেই আযানের সময়ই আমার জন্ম।দীর্ঘ ১১ মাস আমি তার পেটে ছিলাম।কথা সত্যি,তখনকার সময়ে কোনো ওষুধ, চিকিৎসা ব্যবস্থা ছাড়াই নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পরেও সীমাহীন কষ্ট তাকে উপহার দিয়েই আমি পৃথিবীতে এসেছি।প্রি ম্যাচিউর বেবি যেমন হয়,তেমনি আমার মতো সময়ের অনেক পরে জন্ম নেওয়ার ঘটনা ও হয় অজপাড়াগাঁ গুলোতে।জন্মের পরে দেখা গেলো আমি খুব হেলদি বাচ্চা ছিলাম এবং নবজাতকের তুলনায় সাইজ ও বড় ছিল।মা তো প্রায়ই বলে এখনো, নাভী কাটার পরেই নাকি পাড়ার এক দাদি আমাকে কাঁধে করে নিয়ে পুরা উঠোন হেঁটেছে আমার স্বাস্থ্য এবং বড় সাইজ দেখে।সেই আমাকেই আস্তে আস্তে অতিরিক্ত ওজনের কারনে কেউ কোলে বেশিক্ষন রাখতে পারতোনা,কিন্তু আমার মা বুকে রেখে কিভাবে ঘুম পাড়াত ভারি বাচ্চাকে সারারাত কে জানে! আমাদের বাড়ির খড়ের যে চালা ছিল বারান্দায়, সেখানে নাকি কেঁচো হতো খুব।আর মেয়ে হিসেবে জন্ম নিয়েছিলাম বলে আমার মা কে আমার দাদী ঘরে জায়গাই দেয়নি! বারান্দায় ঘুমাত এই কারনে।মেয়ে জন্ম দেওয়ার শাস্তি ছিল এটা তার জন্যে।আমার বাবা তখন চট্টগ্রাম থাকতো।
মোবাইল ছিলনা,চিঠির যুগে নিয়মিত খবর বা যোগাযোগ ও ছিলনা বাড়িতে।আর যোগাযোগ থাকলেও আমার বাবার খুব বেশি কিছু করার ও ছিলনা! একে তো খুবই অল্প বেতন, তার উপর ভীষণ মা ভক্ত ছেলে এটাও একটা কারন ছিল আমার বাবার নিরুত্তাপ থাকার।তো সবসময় এরকম খোলা বারান্দায় শুধু উপরের চালা থেকে কেঁচো পরত বলে মা আমাকে বুকে উপুড় করে রেখে দুই কানে দুটা আঙুল দিয়ে রাখত,যেন কানে পোকা ঢুকে না যায়! আর এইভাবেই আমার মায়ের বুকে ঘুমানোর অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়,আমার ছোট ভাই আমার কিছুটা পিঠাপিঠি বয়সের।তাই ওর যখন জন্ম হলো,তখন তো আমাকে বুকে রাখতে পারত না,কিন্তু আমি খুব চিৎকার করে ”সনি’ক খাট’ত থো,হামাক বুকত নে” এইভাবে চিল্লাতে চিল্লাতে রাতের বেলা পাড়া মাথায় উঠিয়ে রাখতাম।আম্মুও বাধ্য হয়ে ভাইকে পাশে শুইয়ে রেখে আমাকে বুকে নিয়েই ঘুমাত।এখনো গ্রামের মানুষ আমাকে নিয়ে এসব গল্প করে বাড়িতে গেলেই।অতিরিক্ত জেদি, একরোখা,আর চিৎকার করে কান্না করতাম বলে মনমতো কিছু না পেলেই,সেই কারনেই আমার কথা মুরব্বিরা বোধহয় এখনো মনে রেখেছে। ছোটবেলায় কত বড় বিপদেও যে দু একবার পরেছিলাম নিজের বোকামির জন্যে,তখনো আমার ত্রানকর্তা ছিল আমার মা।এখনো আমার পাশে সর্বক্ষন ছায়ার মতো লেগে আছে আমার মা।যদিও বড় হবার সাথে সাথে বুঝতে পারলাম আমার আর মায়ের জীবন নিয়ে চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুতে অবস্থান করে,তারপরও আমার জীবন এর সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী আসলে সেই।
নানারকম কুসংস্কার, সামাজিক, ধর্মীয় গোঁড়ামি তার মধ্যে আছে,আবার জীবনের এমন কিছু ঘটনায় তাকে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে দেখেছি, এমন কিছু কথা বলতে শুনেছি, যাতে মনে হয়েছে আমার মা আসলে খুবই প্রগতিশীল। যেটা কিনা নামধারী অনেক উচ্চশিক্ষিত প্রগতিশীল দের মধ্যেও নেই!! বরং শিক্ষার অভাব,সামাজিক আর ধর্মীয় নিয়মের বেড়াজালে আমার মায়ের ভিতরের প্রগতিশীল রুপ টা সারাজীবন সুপ্তই থেকে গেছে,এরকমই মনে হয় আমার।আর এইকারনেই নানারকম দ্বিমত থাকার পরেও,আমি যে আমার মতো করে চলতে পারছি,এটাতেও আমার মায়ের পরোক্ষ অবদান আছে বলেই পারছি!
গতকাল জন্মদিনেও সবার আগে উইশ করেছে মা! মন ভরে গালে,মুখে চুমু দিয়ে আদর করে দিয়ে আমার দিনটা শুরু করে দিয়েছিল আমার মা’ই।
মা ছাড়া আমি আসলে অচল!
লেখিকা – মিলি